বনফুল কে নিয়ে আমার লেখা ছোট একটি গল্প - পর্ব ৩
জীবনের সর্বক্ষেত্রেই অনুরূপ অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের মোহে মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্গতি কতদূর পৌঁছতে পারে বনফুল তাঁর স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই তা প্রত্যক্ষ করেছেন। ‘কাকের কাণ্ড' গল্পে বায়স-রব অশুভশঙ্কী—এই সংস্কার বশেই জগত্তারিণীর কাক-তাড়ানোর প্রবৃত্তিটি সক্রিয় হয়ে গল্পের পরিণাম রচনা করেছে। কর্তা যে অসুখে মারা যান সেই অসুখটি হবার পূর্বে কাক অমনি অলুক্ষুণে ডাক ডেকেছিল। সন্তান-ভাগ্যে জগত্তারিণী ভাগ্যবতী,—কিন্তু ছেলেমেয়েরা সবাই বিদেশে; কার কি অমঙ্গল হবে এ আশঙ্কায় কাকের ডাক শুনে জগত্তারিণী বিচলিত হয়ে উঠলেন এবং কোমরের ব্যথায় প্রায় অচল হওয়া সত্ত্বেও উঠানে নেমে কাক তাড়াতে গিয়ে পিছলে পড়ে এক কাণ্ড করে বসলেন। অমনি তাঁর কঠিন অসুখের সংবাদ বহন করে চারদিকে তারবার্তা প্রেরিত হল। পুত্রকন্যারা স্ব স্ব দায়িত্বপূর্ণ কাজকর্ম ফেলে রেখে ছুটে এলেন। জননীর অসুখ যতটা কঠিন মনে হয়েছিল ততটা অবশ্য হয়নি। কিন্তু সামান্য একটি কাকের ডাক একটি বিরাট পরিবারে কি হুলস্থুল কাণ্ডটাই না করল! ‘বাঘা' গল্পে হঠাৎ শিরোমণির দিব্যদৃষ্টিতে ধরা পড়ল যে তারিণীচরণের বাঘা কুকুরটি আসলে কুকুর নয়।
এক বৎসর পূর্বে মৃত তারিণীচরণের অগ্রজ সরোজ কুকুরযোনিপ্রাপ্ত হয়ে বাঘার রূপ ধরে এসেছে। বিহ্বল তারিণীচরণ এই প্রেতলৌকিক সংবাদে অভিভূত হয়ে বাঘার বন্ধনদশা মোচন করে যথাকালে স্বস্ত্যয়নাদি কৃত্য সম্পন্ন করলেন এবং কুকুরযোনিপ্রাপ্ত অগ্রজের যথাসাধ্য সেবা করতে লাগলেন। এই ভাবে কিছুদিন যাবার পর কর্মচারী ছাঁটাই-এর কাঁচিতে তারিণীচরণের চাকরি কাটা গেল। এদিকে অগ্রজও অন্নজল ত্যাগ করলেন। শিরোমণি শুনে বললেন, ‘চাকরি গেছে দেখে ও অন্নজল ত্যাগ করবে না তো কে করবে? হাজার হোক্ দাদা তো!' কাজেই দ্বিগুণ কৃতজ্ঞতায় অনুজ অন্ধকার-গৃহকোণাশ্রয়ী অগ্রজকে অনশনব্রত ভঙ্গের জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। ফল যা হবার তাই হল, পাগলা কুকুর তারিণীকে কামড়ে মারা গেল। দিব্যদ্রষ্টা শিরোমণিও বাদ গেলেন না, তাঁকে কামড়ালেন তারিণী নিজে। স্থূলদৃষ্টিসম্পন্ন ডাক্তার বললেন, দুজনেরই জলাতঙ্ক হয়েছে, বাঁচবার আশা নেই, সুতরাং ‘এখন সর্ববাদিসম্মতিক্রমে হরিসংকীর্তন হচ্ছে'। কলৌ নাস্ত্যেব গতিরন্যথা! ‘দিবা দ্বিপ্রহরে' গল্পে সাপের ওঝার প্রতি মানুষের মূঢ় আস্থা পরিহসিত হয়েছে। হারু ঘোষের সেজছেলেকে যে-গোখরো সাপটি কামড়েছিল বিশু বাগদি তাকে বল্লমের আগায় বিঁধে রেখেছে। ছেলেটিকে ডাক্তার যথাসাধ্য ওষুধপত্র লাগিয়ে গেছেন। এমন সময় সেখানে এক আগন্তুকের আবির্ভাব হল, তার কথাবার্তায় সবার ধারণা হল যে, সে একজন গুণী ওঝা। অতএব তার হাতেই সমর্পণ করা হল হারু ঘোষের ছেলেকে। ওস্তাদ সাপটিকে বল্লমমুক্ত করে আদরে তার চুমু খেয়ে নিজের ওস্তাদি দেখালে। ফলে হারু ঘোষের ছেলের মৃতদেহের পাশেই তারও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত দেহটি স্থান পেল। উত্তেজিত জনতা এই অলৌকিক কাণ্ডের পরিণাম অবাক বিস্ময়ে যখন লক্ষ্য করছে তখন জানা গেল যে, যাকে সাপের ওঝা বলে মনে করা হয়েছে আসলে সে একটি পাগল, পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু পাগল, কি শুধু ঐ একটি লোকই ? আমাদের অন্ধভক্তি ও কুসংস্কার যে কত লোককে পাগল করে তুলেছে তার ইয়ত্তা নেই। 'জাগ্রত দেবতা' গল্পে অমনি এক অন্ধবিশ্বাসীর উন্মাদপ্রাপ্তির কাহিনীটি অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। সনাতনপুরের মহাদেব জাগ্রত দেবতা। বৈশাখী