লোকসাহিত্যের আদ্যপান্ত

in Bulls Mind2 years ago

লোকসাহিত্য

লোকসাহিত্য বলতে জনসাধারণের মুখে প্রচলিত গাঁথা কাহিনি, গান, ছড়া, প্রবাদ ইত্যাদিকে বোঝানো হয়। সাধারণত কোনো সম্প্রদায় বা জনগোষ্ঠীর অলিখিত সাহিত্যই লোকসাহিত্য। অর্থাৎ জাতীয় সংস্কৃতির যে সকল সাহিত্যগুণ সম্পন্ন সৃষ্টি প্রধানত মৌখিক ধারা অনুসরণ করে অগ্রসর হয়, তাকে লোকসাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। সুপ্রাচীন কাল থেকে লোকসাহিত্যের বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টি লোকমুখে প্রচলিত হয়ে আসছে এবং পুরাতন সৃষ্টি হয়েও আধুনিক মানবসমাজে সমাদৃত হচ্ছে। লোকসাহিত্য সাধারণত কোনো ব্যক্তিবিশেষের একক সৃষ্টি নয়, তা সংহত সমাজের সামগ্রিক সৃষ্টি। লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ছড়া। প্রাচীন লোকসাহিত্য সংকলন 'হারামনি'র সম্পাদক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন।


folklore-3514261_960_720.jpg

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বাংলা লোকসাহিত্য সার্থক ভাবে উজ্জীবনের পথদ্রষ্টা। আর অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্য বাংলা লোকসাহিত্যের বিভিন্ন ধারার উপর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রথম আলোচনা করেন। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বাংলা লোকসাহিত্য” নামক গ্রন্থে তিনি লোকসাহিত্যকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ৭ ভাগে ভাগ করেন। যথা-
১. গীতিকা
২. লোককাহিনি/ কথা
৩. লোক সংগীত
৪. ছড়া
৫. প্রবাদ
৭. লোকনাটক

গীতিকা:
একশ্রেণির আখ্যানমূলক লোকগীতি বাংলা সাহিত্যে ‘গীতিকা” নামে অভিহিত হয়। ইংরেজিতে তাকে বলা হয় 'ব্যালাড’ (Ballad)। ‘ব্যালাড’ বলতে আখ্যানমূলক লোকসঙ্গীতকে বোঝায়। গীতিকার কাহিনিটি হয় দৃঢ়-সংবদ্ধ। একটি মাত্র পরিণতি লক্ষ্য করে গীতিসংলাপ ও ঘটনাপ্রবাহ কাহিনিকে দ্রুত অগ্রসর করিয়ে নেয়। গীতিকা কাহিনিপ্রধান গতিশীল রচনা এবং তা নাটকীয় গুণসম্পন্ন। সুর সহযোগে গীত হলেও গীতিকায় কথাই মুখ্য, সুর গৌণমাত্র।

বাংলাদেশ থেকে সংগৃহীত লোকগীতিকাগুলোকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে -
১. নাথগীতিকা
২. মৈমনসিংহ গীতিকা
৩. পূর্ববঙ্গ গীতিকা

১. নাথগীতিকা/ মাথ সাহিত্য:

এ অঞ্চলে প্রাচীন কাল থেকে শিব উপাসক এক শ্রোণির যোগী সম্প্রদায় ছিল, তাদের আচরিত ধর্মের নাম না। ম নাথ শব্দটির অর্থ প্রভু। নাথগীতিকার উদ্ভব হয়েছে "নায়ক রাজা গোপীচাঁদ বা গোবিন্দচন্দ্র মাঝের নির্দেশে তরুণ যৌবনে দুই নবপরিণীতা প্রাসাদে রেখে সন্ন্যাস অবলম্বন করেছিলেন" - নাথ ধর্মের এই কাহিনিকে কেন্দ্র করে।

নাথ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মীননাথ। তাঁর আরেক নাম ছিল মৎসেন্দ্রনাথ। গোরক্ষনাথ ছিলেন এই মীননাথের শিষ্য। নাথ সাহিত্যের প্রধান শাখা ২টি। যথা-
ক) গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস: 'গোরক্ষবিজয়' ও 'মীনচেতন' ইত্যাদি।
খ) ময়নামতি: 'মাণিক রাজার গান', 'গোবিন্দচন্দ্রের গীত', 'ময়নামতীর গান', 'গোবিন্দচন্দ্রের গান', 'গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস' ও 'গোপীচাঁদের পাঁচালী' ইত্যাদি।

নাথ সাহিত্যের উল্লেযোগ্য গ্রন্থ:

গ্রন্থকবি ও সম্পাদক
গোৱক্ষ বিজয়এটি রচনা করেন নাথগীতিকার প্রধান কবি শেখ ফয়জুল্লাহ। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ এর সম্পাদনায় এটি প্রকাশিত না।
গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাসএই গীতিকা রচনা করেন শুকুর মাহমুদ। তাঁর জন্ম রাজশাহীর সিন্দুর কুসুম গ্রাম। দিনাজপুর থেকে সংগ্রহ করে এই গীতিকা সম্পাদনা করেন ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী।
মীনচেতনড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী সম্পাদিত অপর এই নাথগীতিকার লেখক ছিলেন শ্যামদাস সেন।
গোরক্ষবিজয়ভীমসেন রায় রচিত এই গীতিকা সম্পদনা করেন ড. পঞ্চানন মণ্ডল।
মানিকচন্দ্র রাজার গানভাষা বিজ্ঞানী স্যার জর্জ গ্রিয়ার্সন রংপুর জেলার মুসলমান কৃষকদের থেকে সংগ্রহ করে ১৮৭৮ সালে এই নাথগীতিকা সংগ্রহটি প্রকাশ করেন।
গোবিন্দ চন্দ্রগীতরচয়িতা – দুর্লভ মল্লিক।
ময়নামতির গানরচয়িতা - ভবানী দাস ভীম।
সাধনমাহাত্ম্যরচয়িতা – মকসেদ আলী।
নাথসাহিত্যের আরো একজন কবি– সেন রায় শ্যাম দাস।

২. মৈমনসিংহ গীতিকা:

ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিভক্ত সাবেক বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাংশে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের বিল, হাওর ও বিভিন্ন নদনদীপ্লাবিত বিস্তৃত ভাটি অঞ্চলে বাংলার শ্রেষ্ঠ গীতিকার যে শতদলগুলো বিকশিত হয়েছিল তা-ই 'মৈমনসিংহ গীতিকা' নামে দেশবিদেশের মনীষীগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তৎকালীন ভিসি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ড. দীনেশচন্দ্র সেনের উদ্যোগে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব গীতিকা সংগৃহীত হয়েছিল তা 'মৈমনসিংহ গীতিকা'ও 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা' নামে চার খণ্ডে ১৯২৩ খ্রি. প্রকাশিত হয়। এই গীতিকা সংগ্রহের দুরূহ কাজটি যোগ্যতার সঙ্গে সম্পাদনা করেছিলেন – চন্দ্রকুমার দে, আশুতোষ চৌধুরী, বিহারীলাল সরকার, পেচা দে, মনোরঞ্জন চৌধুরী, জসীম উদ্দীন প্রমুখ। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ইংরেজি অনুবাদ ও বিস্তারিত আলোচনাসহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হওয়ার পর পরই গীতিকাগুলো অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

পূর্ব ময়মনসিংহের সাধারণ জনসমাজ বিভিন্ন মাতৃতান্ত্রিক উপজাতি দ্বারা গঠিত। এই মাতৃতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য মৈমনসিংহ গীতিকার প্রতিফলিত। মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনিগুলো প্রেমমূলক এবং তাতে নারীচরিত্রই প্রাধান্য পেয়েছে। নারীর ব্যক্তিত্ব, আত্মবোধ স্বাতন্ত্র্য, সতীত্ব প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য এই সব গীতিকায় প্রকাশমান। এখানকার নায়িকারা অপূর্ব প্রেমশক্তির অধিকারিণী হয়ে তাদের নারীধর্ম ও সতীদর্য রক্ষা করেছে। প্রেমের জন্য দুঃখ, তিতিক্ষা, আত্মত্যাগ, সর্বসমর্পণ করে নারী যে কি অসীম মহিমা লাভ করতে পারে, গীতিকাগুলো তারই পরিচায়ক।
মৈমনসিংহ গীতিকার উল্লেখযোগ্য পালা সমূহ:

পালারচয়িতা
মহুয়াদ্বিজ কানাই রচিত এই পালাটিতে বেদের এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে মহুয়ার সঙ্গে বামনকান্দার জমিদার ব্রাহ্মণ যুবক নদের চাঁদের দুর্জয় প্রণয়কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এর রচনাকাল ধরা হয় ১৬৫০ সাল। এই পালায় মোট ৭৮৯টি ভুল আছে। দীনেশচন্দ্র সেন মহুয়া পালাকে ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করেন। ড. সুকুমার সেন 'মৈমনসিংহ গীতিকা' গুলোর মধ্যে মহুয়া গাথাটি সবচেয়ে রোমান্টিক ও মনোরম বিবেচনা করেছেন।
দেওয়ানা মদিনামনসুর বয়াতি রচিত 'দেওয়ানা মদিনা' পালাটি 'মৈমনসিংহ গীতিকা' সংগ্রহের অন্যতম শ্রেষ্ঠগীতিকা হিসেবে সমাদৃত। বানিয়াচঙ্গের দেওয়ান সোনাফরের পুত্র আলাল ও দুলালের বিচিত্র জীবনিকাহন এবং দুলাল ও গৃহস্থ মদিনার প্রেমকাহিনি এই পালার বিষয়বস্তু।
মলুয়া ও দস্যু কেনারামচন্দ্রাবতী মৈমনসিংহ গীতিকার এই দুটি পালা রচনা করেন। এ কবি ষোড়শ শতাব্দীর কবি এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম বাঙালি মহিলা কবি। এ দুটির মধ্যে মলুয়া গাথার মোট ছত্রসংখ্যা ১২৪৭। পালাটি মোট ১৯টি অঙ্কে বিভক্ত।
কমলাপালাটির রচয়িতা দ্বিজ ঈশান। মূল চরিত্র কমলার নাম থেকে পালার নামকরণ করা হয়েছে। কমলা পালায় মোট ১৩২০টি ছত্র এবং ১৭টি অঙ্কে বিভক্ত।
কাজলরেখামৈমনসিংহ গীতিকায় যুক্ত হওয়া একমাত্র রূপকথা ‘কাজল রেখা’ পালা। এই পালার রচয়িতা অজ্ঞাত। এই পালার কিছুটা সংক্ষিপ্ত রূপ সংকলিত হয়েছে দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’তে।
কঙ্ক ও লীলাএই পালার রচিয়তা ৪ জন যথা – দামোদর, রঘুসুত, নয়ানচাঁদ ঘোষ ও শ্রীনাথ বেনিয়া।
চন্দ্রাবতী ও জয়চন্দ্ররচয়িতা- নয়ানচাঁদ ঘোষ।
দেওয়ানা ভাবনা ও রূপবতীএই দুটির রচয়িতা অজ্ঞাত।

৩. পূর্ববঙ্গ গীতিকা:
‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ নামে পরিচিত গীতিকাগুলোর কয়েকটা পূর্ব ময়মনসিংহ থেকে এবং অবশিষ্ট গীতিকাগুলো নোয়াখালী, চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে সংগৃহীত। এ অঞ্চলের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে গীতিকাগুলোর মধ্যে দুঃসাহসিক ঘটনাপূর্ণ কাহিনি স্থান পেয়েছে। উল্লেখযোগ্য পালা ‘নিজাম ডাকাতের পালা’, ‘কাফন চোরা’, ‘চৌধুরীর লড়াই’, ‘ভেলুয়া’, ‘নুরুন্নেহা ও কবরের কথা’, ‘কমল সদাগর’, ‘সুজা তনয়ার বিলাপ’, ‘পরীবানুর হাঁহলা’ ইত্যাদি।

→ লোককাহিনি/কথা:

গদ্যের মাধ্যমে কাহিনি বর্ণিত হলে তাকে ‘কথা’ বা ‘লোককথা’ বা ‘লোককাহিনি' বলা হয়ে থাকে। মানুষের গল্প শোনার সহজাত ও চিরন্তন প্রবৃত্তি থেকে এগুলোর উদ্ভব এবং সুদূর অতীত থেকে এর যাত্রা শুরু হয়ে পরিমার্জন ও নতুনতর সংযোজনের মাধ্যমে বর্তমান কালে এসে পৌঁছেছে।

বি.দ্র. কাহিনিগুলো কাব্যে রূপায়িত হলে ‘গীতিকা’ এবং গদ্যে হলে ‘কথা' নামে পরিচিত হয়।

ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য লোককথাকে ৩ ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা-

১. রূপকথা
২. উপকথা
৩. ব্রতকথা

১. রূপকথা:

রূপকথা হলো শিশুতোষ কল্পকাহিনি যে গুলোকে ইংরেজিতে বলে Fairy Tales. এগুলো অন্যান্য লোককথা থেকে দীর্ঘতর হয় এবং চরিত্র হিসেবে রাজা, রাণী, রাজপুত্র, রাজকন্যা ইত্যাদি মানব চরিত্র পাওয়া যায়।

বাংলাভাষার রূপকথার শ্রেষ্ঠ সংগ্রাহক দক্ষিণারঞ্চন মিত্র মজুমদার। তাঁর সংগৃহীত রূপকথার গ্রন্থগুলো হলো- ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদাদার ঝুলি, দাদামহাশয়ের থলে (রসকথা), ঠানদাদির থলে (ব্রতকথা)।

তাঁর এই অবদানের জন্য বঙ্গীয়সাহিত্য পরিষদ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে তাঁকে ‘কথাসাহিত্য সম্রাট’ উপাধি প্রদান করেন। ঠাকুরমার ঝুলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, 'ঠাকুরমার ঝুলি হলো বাংলার রস’। আর ‘দ্যা টাইমস অব লন্ডন’ এর মন্তব্য ছিল ‘দি মোস্ট ওয়ান্ডারফুল ভলিউমস'। ঠাকুরমার ঝুলি ইংরেজি ব্যতীত জার্মান ভাষায়ও অনূদিত হয়। ‘টুনটুনির বই’ নামে রূপকথার একটি গ্রন্থ সংগ্রহ করেন উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী।

২. উপকথা:
উপকথার কাহিনিগুলো গড়ে ওঠেছে বিভিন্ন পশুপাখির চরিত্র অবলম্বনে। এতে মানব চরিত্রের মতোই পশুপাখির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে বক্তব্য পরিবেশিত হয়েছে। কৌতুকরস এবং নীতিপ্রচারের জন্যই এগুলো সৃষ্টি। ঈশপের গল্পগুলো উপকথার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

৩. ব্রতকথা:
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়েলি ব্রতের সঙ্গে সম্পর্কিত কাহিনি অবলম্বনে ব্রতকথা নামে এক ধরনের লোককথার বিকাশ ঘটেছে। ব্রতকথার কাজ গার্হস্থ্য কর্তব্য সাধন। গার্হস্থ্য সুখসমৃদ্ধি বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা মিটানোই এর লক্ষ্য। ব্রতকথার মধ্য দিয়ে বাংলার সমাজ জীবনের চিত্র পাওয়া যায়।

Coin Marketplace

STEEM 0.19
TRX 0.15
JST 0.029
BTC 63398.53
ETH 2660.51
USDT 1.00
SBD 2.77