মর্সিয়া সাহিত্য সম্ভার ও অনুবাদ সাহিত্য সংক্রান্ত তথ্যাবলি

in Bulls Mind2 years ago

মর্সিয়া সাহিত্য

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে 'মর্সিয়া সাহিত্য' নামে এক ধরনের শোককাব্য বিস্তৃত অঙ্গন জুড়ে ছড়িনো রয়েছে। 'মর্সিয়া' কথাটি আরবি, এর অর্থ শোক প্রকাশ করা। আরবি সাহিত্যে কারবালা প্রান্তরে নিহত ইমাম হোসেন ও অন্যান্য শহীদকে উপজীব্য করে লেখা কবিতা মর্সিয়া নামে আখ্যাত হয়। এ আদর্শ অনুসরণ করে বাংলা ভাষায় মর্সিয়া সাহিত্যের প্রচলন হয়। মর্সিয়া সাহিত্যের প্রচলনের পিছনে পারস্য দেশীয় প্রণিক, দরবেশ, পণ্ডিত, কবি প্রমুখের অনুপ্রেরণা বিশেষ ভাবে কাজ করেছে।

এসব কাব্যের কোনো কোনোটি যুদ্ধ কাব্য হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। এ জন্য এ কাব্যগুলোকে 'জঙ্গনামা'ও বলা হয়ে থাকে। যুদ্ধের কাহিনি নিে কোনো কোনোটি পরিণতিতে চরম বিয়োগাত্মক রূপে গ্রহণ করেছে। শেষে কাব্য হয়ে উঠেছে মূর্সিয়া বা শোক কাব্য। মোঘল আমলে মুর্শিদাবাদ, ঢাকা প্রভৃতি অঞ্চলে শিয়া শাসক ও আমীর ওমরাগণ শাসনকার্য উপলক্ষে এসে বসবাস করতেন। মুসলমানদের মধ্যে শিয়া সম্প্রদানের লোকেরা মর্সিয়া সাহিত্য বিকাশের প্রেরণা দান করেন। তৎকালীন শিয়া শাসকরা কবিগণকে উৎসাহ প্রদান করতেন।


d2caa68c07b7a3ffd23ced1a1726-1456175.jpg

মর্সিয়া সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কাব্য:

জয়নবের চৌতিশাএটি মর্সিয়া সাহিত্যের প্রথম কাব্য। ১৫৭০ সালে লিখিত এ কাব্যের কবি শেখ ফয়জুল্লাহ মর্সিয়া সাহিত্যের আদি কবি।
জঙ্গনামা/ মকুল হোসেনদৌলত উজির বাহরাম খান রচিত মর্সিয়া কাব্যটি তাঁর রচিত প্রথম কাব্য। বাহরাম খান চট্টগ্রামের অধিবাসী ছিলেন।
মক্তুল হোসেনমুহমাদ খান রচিত এ কাব্যটি মর্সিয়া সাহিত্যের শ্রেষ্ঠকাব্য। এ কবিও চট্টগ্রামের অধিবাসী।
কাশিমের লড়াই, ফাতিমার সুরতনামাশেখ শেররাজ চৌধুরী। এ কবির নিবাস ছিল ত্রিপুরা।
জঙ্গনামারংপুর ঝাড়বিশিলা গ্রামের কবি হায়াত মামুদ এই মর্সিয়া কাব্যটির প্রণেতা।
শহীদ-ই কারবালা ও সখিনার বিলাপরচয়িতা জাফর।
হানিফার কারবালা যাত্রারচয়িতা - নজর আলী।
হানিফার লড়াইরচয়িতা আবদুল আলিম।
জঙ্গনামা আমির হামজারচয়িতা - ফকির গরীবুল্লাহ।
কাসেম-বধরচয়িতা - হামিদ আলী।
ইমামগনের কেচ্ছা এবং আফৎনামারচয়িতা - রাধারমন গোপ (তিনি মর্সিয়া সাহিত্যের হিন্দু কবি)।

কবিগান:

কবিগান এমন এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক গান, যা তাৎক্ষণিকভাবে রচিত ছড়া ও গানের মাধ্যমে দুই দল গায়ককে প্রথমে পালাক্রমে এবং শেষে সম্মিলিতভাবে পরিবেশন করতে হয়। কবিগানের একটি জনপ্রিয় প্রতিশব্দ ‘কবির লড়াই’। দলের দলপতিকে বলা হয় সরকার বা কবিয়াল। ড. সুশীলকুমার দেবের মতে, কবিগানের বিশেষ গৌরবের যুগ (১৭৩০ - ১৮৩০) খ্রিস্টাব্দ। সাধারণত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা কবিগানের রচয়িতা ছিল। সে কারণে হিন্দু সমাজে তাদেরকে কবিওয়ালা বলা হতো। কবিগানের মুসলিম রচয়িতাদের বলা হয় – শায়ের।

কবিগানের উল্লেখযোগ্য কবি:

১. গোঁজলা গুই/গোঁজলা পুট – কবিগানের আদি কবি।
২. হারু ঠাকুর – শ্রেষ্ঠ কবিয়াল। তিনি মহারাজা নবকৃষ্ণের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।
৩. রাসু-নৃসিংহ – জন্ম চন্দনগরে। রাসু ও নৃসিংহ দুই ভাই।
৪. এন্টনি ফিরিঙ্গি – জাতিতে পর্তুগিজ এবং ধর্মে খ্রিস্টান। বিধবা ব্রাহ্মণী বিয়ে করে বাঙালি হন। তাঁকে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র- এন্টনি ফিরিঙ্গি
এবং জাতিস্মর।
৫. নিতাই বৈরাগী – প্রকৃত নাম – নিত্যানন্দ দাস বৈরাগী। তিনি সারা দেশেই খ্যাতি লাভ করেন।
৬. কেষ্টা মুচি।
৭. রামবসু/ রামমোহন বসু।
৮. ভবানী বেনে।
৯. ভোলা ময়রা – প্রকৃত নাম ভোলানাথ নায়ক।

● কবিগানের রচয়িতা ও গায়ক হিসেবে পরিচিত – রামবসু, ভোলা ময়রা।
● নিধুবাবু ও টপ্পা গান – তিনি বাংলা টপ্পা গানের জনক বা টপ্পার রাজা। “নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা” – নিধুবাবুর রচনা।
● টপ্পা গানকে আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার উৎস মনে করা হয়। টপ্পার অন্যান্য কবি – কালী মির্জা, শ্রীধর কথক।
● দাশরথি রায় – তিনি পাঁচালীগানের শক্তিশালী কবি। তিনি দাশু রায় নামে পরিচিত।

পুঁথি সাহিত্য বা দোভাষী পুঁথি সাহিত্য:

আঠার শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে রচিত ‘আরবি-ফারসি’ শব্দ মিশ্রিত ইসলামি চেতনাসম্পৃক্ত এক ধরনের বিশেষ ভাষারীতিতে যে সমস্ত কাব্য রচিত হয়েছিল তা ‘পুঁথি’ সাহিত্য নামে পরিচিত। আরবি, ফারসি সহ কয়েকটি ভাষার শব্দ ব্যবহার করে মিশ্রিত ভাষায় রচিত পুঁথিকে দোভাষী পুঁথি সাহিত্য বলা যায়। কলকাতার বটতলার সস্তা ছাপাখানা থেকে মুদ্রিত হয়ে এই ধারার কাব্য দেশময় প্রচারিত হয়েছিল বলে বটতলার পুঁথি নামেও একে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চলছে।

পুঁথি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি:

ফকির গরীবুল্লাহ্: পুঁথি সাহিত্যের প্রথম সার্থক ও জনপ্রিয় কবি ফকির গরীবুল্লাহ্। তিনি হুগলি জেলার কালিয়া পরগনার হাফিজপুর গ্রামের
অধিবাসী ছিলেন।
তাঁর কাব্যগুলো হলো:

১. ইউসুফ-জোলেখা২. আমীর হামজা (প্রথম অংশ)৩. জঙ্গনামা৪. সোনাভান৫. সত্যপীরের পুঁথি

‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্যটি চৌদ্দ শতকে রচিত।

২. আমীর হামজা (প্রথম অংশ) ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্যটি চৌদ্দ শতকে রচিত। সৈয়দ হামজা: তিনি ফকির গরীবুল্লাহ্র অনুসারী ছিলেন। তাঁর কাব্যগুলো হল:

১. আমীর হামজা কাব্যের শেষ অংশ২.মধুমালতী৩. হাতেম তাঈ৪. জৈগুনের পুঁথি

মোহাম্মদ দানেশ: তাঁর রচিত কাব্য সমূহ -নুরুল ইমান, হাতেম তাঈ, চাহার দরবেশ, গোলবে ছানুয়ার।

‘গাজী-কালু চম্পাবতী’ এর লেখক আব্দুল হাকিম ও আব্দুল গফুর। এ পুঁথিতে ফকিরদের প্রতিষ্ঠার কথা পাওয়া যায়।

অনুবাদ সাহিত্য সংক্রান্ত তথ্যাবলি:

মধ্যযুগের সাহিত্যের একটি সমৃদ্ধ ধারা ‘অনুবাদ সাহিত্য'। সাধারণত হিন্দি, আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষা থেকেই বেশিরভাগ সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। অনুবাদের ক্ষেত্রে কবিরা মূল কাহিনি অপরিবর্তিত রেখে কিছু নিজস্ব সংযোজনের মাধ্যমে ভাবানুবাদ করেছেন। পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন মুসলমান শাসকগণ।

উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:

রামায়ণ:

রামায়ণ একটি প্রাচীন সংস্কৃত মহাকাব্য। আদিকবি ঋষি বাল্মীকি ‘রামায়ণ' রচনা করেন। তাঁর পূর্বনাম রত্নাকর দস্যু। ‘বাল্মীকি’ মানে হলো ‘উইপোকার ঢিবি'। তিনি তমসা নদীর তীরে বসে সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন। রামায়ণ ৭টি কাণ্ড (পর্ব) ও ৫০০টি সর্গে বিভক্ত ২৪,০০০ শ্লোকের সমষ্টি। পর্ব ৭টি – বাল, অযোধ্যা, আরণ্য, কিষ্কিন্ধ্যা, সুন্দর, লঙ্কা ও উত্তর। এই কাব্যের মূল উপজীব্য বিষয় বিষ্ণুর অবতার রামের জীবনকাহিনি। এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম অনূদিত গ্রন্থ।

রামায়ণের অনুবাদক কবি –

কৃত্তিবাস ওঝা: তিনি রামায়ণের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি। তিনি অনুবাদ সাহিত্যের প্রথম কবি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে কাব্য রচনা কাল পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি। তাঁর অনূদিত রামায়ণের নাম – ‘শ্রীরাম পাঁচালি'। তাঁর পারিবারিক পদবী – মুখোপাধ্যায়। তাঁর রামায়ণকে বাঙ্গালির জাতীয় কাব্য বলা হয়। গ্রন্থটি ১৮০২ – ১৮০৩ সালে উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে শ্রীরামপুর মিশন থেকে মুদ্রিত হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে – গৌড়েশ্বর জালালুদ্দিন মাহমুদ শাহের অনুরোধে তিনি এ কাব্য রচনা করেন। মধুসূদন দত্ত কবিকে ‘এ বঙ্গের অলঙ্কার’ বলে আখ্যায়িত করেন। চরণটি ছিল – “কৃত্তিবাস কীর্তিবাস কবি, এ বঙ্গের অলঙ্কার।”

অদ্ভুতাচার্য: কবির প্রকৃত নাম নিত্যানন্দ আচার্য। তিনি ‘অদ্ভুত আশ্চর্য রামায়ণ কথা’ নামে রামায়ণ অনুবাদ করে এ নামে পরিচিতি লাভ করেন।
চন্দ্রাবতী: তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি। তাঁর বাবা মনসামঙ্গল কাব্যের কবি দ্বিজ বংশীদাস। বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলায়। ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মতে – তাঁর জন্ম ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে। তিনি মৈয়মনসিংহ গীতিকার ‘মলুয়া’ ও ‘দস্যু কেনারামের পালা' গীতিকা দুটি রচনা করেন।

মহাভারত:

প্রাচীন ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্যের মধ্যে সংস্কৃত ভাষায় রচিত অন্যতম মহাকাব্য ‘মহাভারত’। এর মূল রচয়িতা – মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। 'বেদ' এর ব্যাখা করেছিলেন বলে তাঁর অপর নাম বেদব্যাস। মহাভারতে – ১৮টি খণ্ড এবং ৮৫,০০০ শ্লোক আছে। এর মূল উপজীব্য বিষয় হলো কৌরব ও পাণ্ডবদের গৃহবিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি। এ কাব্যের উল্লেখযোগ্য চরিত্র – ভীষ্ম, দ্রোনাচার্য, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, দ্রৌপদী, অভিমন্যু, কুন্তী, কর্ণ, গান্ধারী, দুর্যোধন, দুঃশাসন প্রমূখ। দ্রৌপদী মহাভারতে পাঁচ ভাইয়ের (যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব) একক স্ত্রী।

মহাভারতের অনুবাদক কবি:

কবীন্দ্র পরমেশ্বর: মহাভারতের প্রথম অনুবাদক কবি। তিনি চট্টগ্রামের শাসক আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সেনাপতি লস্কর পরাগল খানের নির্দেশে মহাভারত অনুবাদ করেন। তার মহাভারত ‘পরাগলী মহাভারত' নামে পরিচিত। তাঁর মহাভারতের নাম – ‘বিজয়পাণ্ডব কথা/ ‘ভারত পাঁচালী’।

শ্রীকর নন্দী: পরাগল খানের পুত্র ছুটি খানের নির্দেশে মহাভারত অনুবাদ করেন। তাঁর মহাভারত ছুটিখানী মহাভারত নামে পরিচিত।

কাশীরাম দাস: মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি। জন্ম – বর্ধমান জেলার সিদ্ধি গ্রাম। তিনি মহাভারতের চার পর্ব অনুবাদ করেন।

ভাগবত:

ভাগবত – (পুরাণ) বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় অনুবাদ গ্রন্থ। মূল রচয়িতা – মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ ব্যাসদেব (বেদব্যাস)। পুরাণ: সংস্কৃত ভাষায় রচিত ধর্ম বিষয়ক আখ্যান কাব্য পুরাণ নামে অভিহিত। পুরাণ ৩৬টি। ১৮টি মহাপুরাণ, ১৮টি উপপুরাণ বা অর্বাচীন পুরাণ। ভাগবত পুরাণ ১৮টি মহাপুরাণের অন্যতম। ভাগবতে দ্বাদশ স্কন্ধ বা পর্ব, ৩৩২ টি অধ্যায় এবং ১৮,০০০ শ্লোক আছে।

ভাগবতের অনুবাদক কবি:

মালাধর বসু – তিনি ভাগবতের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কবি। তিনি অনুবাদ সাহিত্যের দ্বিতীয় কবি। তিনি হোসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় কাব্য চর্চা করেন। তাঁর কাব্যের নাম – ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’ (ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধ অনুসরণে)। তাঁর কাব্য ‘গোবিন্দবিজয়’ বা ‘গোবিন্দমঙ্গল' নামেও পরিচিত। উপাধি – গুণরাজ খান। ড. সুকুমার সেনের মতে, গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বারবাক শাহ তাঁকে এ উপাধি প্রদান করেন।

কোরআন শরীফের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন। তিনি ১৮৮৬ সালে কোরআন শরীফ অনুবাদ করেন। তাঁর উপাধি হলো ‘ভাই’। তাঁর বাড়ি ছিল নরসিংদী জেলায়। তিনি ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের অনুসারী। এছাড়াও তিনি ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’ অবলম্বনে ‘তাপসমালা’ রচনা করেন।

Coin Marketplace

STEEM 0.36
TRX 0.12
JST 0.040
BTC 70446.49
ETH 3571.68
USDT 1.00
SBD 4.73